Published

দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্প : ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর বিশ্বময় প্রভাব

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মূলনীতি বাস্তবায়নে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার এই নীতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনবে না, বরং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলবে।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির উদ্দেশ্য ও প্রভাব

ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি মূলত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক প্রোটেকশনিজম বৃদ্ধি, বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে আসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কৌশলগত অংশগ্রহণ কমানো। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নীতির বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করবে। ন্যাটো, জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর এই নীতির প্রভাব দৃশ্যমান হবে।

বিশ্বরাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্যযুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এই নীতির মাধ্যমে নতুন মাত্রা পাবে।

১. জলবায়ু পরিবর্তন

ট্রাম্প প্রশাসন যদি প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বৈশ্বিক জলবায়ু আন্দোলন বিপর্যস্ত হতে পারে। কার্বন নির্গমন নিয়ে উদাসীন মনোভাব পরিবেশ সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে।

২. বাণিজ্য যুদ্ধ

চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হবে। আমদানি শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে নিজ দেশের উৎপাদকদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার সৃষ্টি করতে পারে।

৩. মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমানোর ফলে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

৪. মার্কিন নেতৃত্বের ইতিহাস ও এশিয়ার প্রভাব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর সব সাগরপথের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

তৎকালীন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ ছিল না। ইউরোপ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, চীন নিজ অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ব্যস্ত, আর রাশিয়া পুঁজিবাদ থেকে দূরে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সহজেই অগ্রসর হয়।

৫. এশিয়ার ভূ-রাজনীতি

একবিংশ শতকে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এ অঞ্চলে বাস করে, যার মধ্যে চীন ও ভারতের মতো শক্তিশালী দেশ রয়েছে।

ভ্যালেরিপিয়েরিস সার্কেলের মাধ্যমে দেখা যায়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ মিয়ানমারের মং খেত শহরকে কেন্দ্র করে ৩,৩০০ কিলোমিটারের একটি বৃত্তের মধ্যে বসবাস করে। এই বৃত্তে রয়েছে ভারত, চীনের অংশ, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন।

২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতির অর্ধেক উৎপাদন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসবে বলে ধারণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব এশিয়ায় সময় ও অর্থের বিনিয়োগ বাড়াবে।

৬. যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে পূর্ব এশিয়ার ওপর তাদের প্রভাব বজায় রাখা। যেমন- উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় ইউএস মেরিন ঘাঁটি স্থাপন এবং জাপানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক দৃঢ় করা। তবে জাপানের শক্তি যেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি না হয়ে ওঠে, সেদিকেও তাদের সতর্ক দৃষ্টি থাকবে।

মালাক্কা প্রণালির পাশের দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সম্পর্কও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সরু প্রণালির মাধ্যমে চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ১২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়।

৭. ল্যাটিন আমেরিকা

ল্যাটিন আমেরিকার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে পানামা খালের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে। চীনের পরিকল্পিত নিকারাগুয়া খালের অগ্রগতির ওপরও নজর রাখবে তারা। এ ছাড়া ব্রাজিল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে কি না, তা-ও পর্যবেক্ষণ করবে।

কিউবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ছাড় দেবে না। ল্যাটিন আমেরিকার ওপর প্রভাব নিয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে।

এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখবে না, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ তৈরি করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *